উপবৃত্তির সাতকাহন

এই লেখাটি প্রাথমিক বিদ্যলয়ের শিক্ষক ছাড়া অন্য কাউকে পড়তে নিরূৎসাহিত করছি। পড়লে নিজ দায়িত্বে পড়বেন এছাড়াও শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ এই লেখাটিতে অসংখ্য ভুল রয়েছে। বিশেষ করে যাদের গুরুচন্ডালি দোষ এবং বাণান ভুল ধরার অভ্যাস রয়েছে তারা পড়বেন না। 

উপবৃত্তি বিতরনের সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় জুন/২০১৫ মাসে। এর পর কেটে যায় প্রায় ৭/৮ মাস। কোন সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি মাঠপর্যায়ে। কখনো শুনেছি উপবৃত্তি আর দেয়া হবে না, কখনো শুনেছি উপবৃত্তির পরিবর্তে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করা হবে আবার কখনো শুনেছি বিস্কুট দেয়া হবে। আর এই শোনায় শোনায় কেটে গেল ৭/৮ মাস। অবশেষে সকল শোনার অবসান করে উনি (অর্ডার/চিঠি) আসলেন। উনি আসার পর জানতে পারলাম
সবাইকে (১০০%) উপবৃত্তি দেয়া হবে এবং ২০১৫ সালের জুন মাস থেকেই দেয়া হবে। এই অর্ডার দেখিয়া আমাদের সরাসরি বসেরা আমাদের কাছে উপবৃত্তির চাহিদা (পূর্বের মত ফরমেটে) চাহিলেন। আমরা তাদের কাছে আরো ব্যাখ্যা চাইলাম তাহারা বলিলেন জুলাই-সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর আপনারা যে চাহিদা দিয়েছেন (আমরা যারা মেয়াদান্তে পূর্বর ন্যায় চাহিদা দিয়েছিলাম তাদের ক্ষেত্রে) ওটা বাদে বাকি ছাত্রের চাহিদা দিন এবং এ বছরের (২০১৬ সালের) সকল ছাত্রের জানুয়ারি- মার্চ চাহিদা জমা দিন। আমরা তাহাদের গৃহপালিত........ ন্যায় করিয়া জমা দিলাম। অত:পর কেটে গেল আরো কিছু কাল। হঠাৎ একদিন একখানা চিঠি ও কিছু ফরমেট আমাদের উপর নাজিল হল। যার আগা-গোরা, মাথা-মুন্ডু কিছুই আমারা খুইজা পেলাম না। অন্ধকারে হাতরাতে লাগলাম। কারন ছবি সহ বেশ কয়েকটি ব্যাপারে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ছিল। তারপরও আমারা কাজের কাজি মাষ্টার মশাইরা প্রাইমারি স্কুলটাকে উপবৃত্তির আফিস বানাইয়া কোমলমতি ফেরেস্তা তুল্য বাচ্চাদের লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়া আট-সাট বাধিয়া নামিয়া পরিলাম। ছবি সংগ্রহ, ভোটার আইডি জোগাড়, প্রত্যেক বছরের জন্য ৩ টি করে মোট ৬টি রেজিস্টার তৈরি, ত্রৈমাসিক চাহিদা তৈরি ইত্যাদি হরেকরকম কাজে। এরকম ভাবে আমারা সারা বাংলার সকল শিক্ষক কাম উপবৃত্তি প্রকল্প বাস্তবায়নকারি করমচারিরা সারা কর্মদিবস তো বটেই রাত উবদি শুধু করিতেই থাকিলাম। যাহা এই বাংলার অনেকেই বদন বইয়ের বদৌলতে দেকেচেন যে, কেউ মোমবাতি জ্বালাইয়া আবার কেউ বিদ্যুতের ঝলকে শুধু করিতেছেন আর করিতেছেন।
একটু তাড়া করেই করিলাম কারন সামনে রমজান মাস, বন্ধে একটু রিলাক্সে থাকব। তাই সারা বাংলার সকল মাষ্টাররাই রমজানের আগে সর্বশেষ নির্দেশনা মোতাবেক সকল হুকুম পালন করে ছুটিতে গেলাম। মহা আনন্দে রমজানের রোজা রেখে ভালই চলছিল দিন। যে যার মতো বেড়াতেও লাগলাম………..।
রমজানের ছুটির দু, চার দিন যেতে না যেতেই আবারো আমাদের উপর নাজিল হল আজব বানী। ঐ বাণীতে বলা হল প্রত্যেক স্কুলের উপবৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র ছাত্রীর অভিভাবকদের সকলের মোবাইল নম্বর দিতে হবে এবং আলটিমেটাম দেয়া হল ২৪ ঘন্টার। আমরা আবার করিতে লাগিয়া গেলাম। করিতে করিতে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হইয়া একেবারে হতাস হলাম (স্কুল বন্ধ থাকার কারণে) তখন ১২ ঘন্টার ব্যবধানে আর একখানা হুকুম নাজিল হল। ঐ হুকুমে আমাদের আলটিমেটামের সময় আরো ১২ ঘন্টা বর্ধিত করা হইল। আমরা একটু আশান্বিত হইয়া আবার করিতে লাগিলাম। করিতেই থাকিলাম…… । ইতিমধ্যেই আলটিমেটামের সময় শেষ হইয়া গেল। আর কোন হুকুম আসিল না। আমারাও ঘাপটি মারিয়া শুধু করিতেই থাকলাম। এভাবে আরো দু, চার- পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। আমাদেরও করা প্রায় শেষ। এমন সময় আর একখানা হুকুম আসল। যাহাতে নির্দিষ্ট করিয়া দেয়া হলো যে, উল্লেখিত ৬০/৬৫ খানা উপজেলা ছাড়া সবাইকে পূর্বের ন্যায় কার্ডের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেয়া হবে। সুতরাং উল্লেখিত উপজেলার মাষ্টাররাই মেবাইল নম্বর দিবে অন্যরা না দিলেও চলবে। কিন্তু আমারা সকলেই করলাম।
যাই হোক এবার কার্ড। ঐ সময়েই কার্ড দেয়া শুরু হল। হয়ত ২৫% এলাকায়ও কার্ড পৌছায়নি এমন সময় আর এক খানা আদেশ নাজিল হল যাহাতে বলা হল ২০ জুলাইয়ের মধ্যে উপবৃত্তি বিতরণ সম্পন্ন করতে হবে। তবে অনেক উপজেলাতেই কার্ড পেয়েছে স্কুল খোলার পর অর্থাৎ ১১ তারিখে বা ঈদের দু, চার দিন আগে। আমরা ঈদের বিশাল লম্বা ছুটি কাটাইয়া ১১ তারিখে স্কুলে জয়েন করিয়া বাচ্চাদের বলিলাম পড়তে থাক, লিখতে থাক আর আমরা কার্ড লিখি, তোমাদের টাকা দিব। বাচ্চারা মহা শান্তি পাইয়া সারাদিন হৈ-হুল্লো করে দিন কাটাইতে লাগিল আর আমরা কার্ড লিখিতে থাকলাম………।
মজার ব্যাপার হলো আমার কেন্দ্রে উপবৃত্তি বিতরণের তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে ১৭ জুলাই রবিবার। কিন্তু ঈদের চার দিন আগে আমাদের অফিস থেকে মোট ছাত্র ছাত্রির ২৫% কার্ড দিয়ে বলা হলো নতুন যারা উপবৃত্তির প্রাপ্ত হয়েছে তাদের নাম এগুলোতে লিখবেন আর পূর্বে থেকে যারা পায় তাদের পুরানো কার্ড দিয়ে কাজ সারবেন এবং একাধিক সন্তানের পরিবারের কোন কার্ড দেয়া হলো না। বসরা বললেন কার্ড নেই আসলে দিব। আমরা তাদের হুকুম মত নতুন উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র/ছাত্রীর নামে কার্ড করলাম আর পুরানো কার্ডগুলো বাছাই করিয়া কাজ ওকে করলাম স্কুল খোলা তারিখে অর্থাৎ ১১ তারিখ। কিন্তু ১২ তারিখে আরো কিছু কার্ড দিল আর বল্ল সবার জন্য নতুন করে কার্ড করতে হবে। আমারা আবার করিলাম এবং আজও কিরলাম। কিন্তু শেষ করিতে পারলাম না। কারণ কার্ড সর্ট। অফিসে আলাপ করলাম অফিস বল্ল কার্ড নেই আজ (১৪ তারিখ) আনতে যাব। আপনাদের শনিবারে দিব।
তো এবার বলুন শনিবারে কার্ড দিবে। সেই কার্ড এনে আমরা লিখব, ছবি লাগাব, অভিভাবকের স্বাক্ষর নেব, হেড স্যার স্বাক্ষর করবেন, এইউইও স্বাক্ষর করবেন, ইউইও স্বাক্ষর করবেন, ব্যাংক ম্যানেজার স্বাক্ষর করবেন এরপর রবিবার উপবৃত্তি বিতরণ করব। করব। অবশ্যই করব। এভাবেই করব। করতেই থাকব। কারণ এ পর্যন্ত আমরা করে আসছি। ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় সকল শিক্ষার্থীর মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করতে পারি এটাও পারব। করে করে একদিন ঠিকই কাজ শেষ করব। তবে প্রত্যকটা করায় করা শেষ হবে এ রকম উপাখ্যান লেখা শেষ হবে না। ধন্যবাদ।।

মরাল : মানসম্মত শিক্ষা দিতে টাকা লাগে না, ১৯৬০ টাকা প্লেটের ইফতারি খেয়ে বক্তারা বলেন।

বি:দ্র: এই লেখাটি শুধুমাত্র আমাদের শিক্ষকদের জন্য। অন্য কেউ পড়লে নিজ দায়িত্বে পরবেন। কারণ এটি পড়ার পর কারো মাথা ঝিম ঝিম বা পেট খারাপ হলে কোন ক্রমেই লেখক দায়ী থাকবে না।

No comments:

Post a Comment